বাচ্চার জন্য পরিবেশ তৈরী করতে পারলে কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। এই জন্য আমার কাছে মনে হয় বাসার চেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর কোথাও নেই।
এই বিষয়টা আমি কিছুদিন আগে অনুভব করতে পারলাম।
বলছি কিভাবে ? সকল মায়েরাই সন্তান বড় করতে অনেক কষ্ট করেন
সেগুলা লিখার বা বুজানোর কোন আসলে ভাষা নেই। তবে বর্তমানে মায়েরা মনে হয় শারীরিক কষ্টের থেকে মানুষিক কষ্ট বেশী করেন। আমার ধারণা।
কারণ এখন পরিবার ছোট হয়ে আসছে। একাই বাচ্চা সংসার মোটেও সহজ বিষয় নয়।
আমাদের পরিবেশ
আমরা থাকতাম মিরপুর ১৪ নাম্বারে খুব ছোট একটা ফ্ল্যাটের তিন তলায়।
খুব বেশি আলো বাতাস আসার সু ব্যবস্থা ছিল না।
ছাদ সারাক্ষন তালা দেওয়া থাকে।
কোন দরকার হলে দুই তলায় মালিকের কাছে চাবি নিয়ে আসতে হত।
বিষয়টা আমার কাছে বিরক্তিকর।
কারণ বিছানার চাদরের মত বড় কাপড় ধুয়ে শুখাইতে দিলে ,
ছাদের দরকার হয় কিন্তু বার বার চাবির জন্য
দরজায় নক করা আমার জন্য অস্বস্তিকর ছিল।
তাই সকল কাপড় বেশির ভাগ সময় বারান্দায় দিতাম।
সেখানে খুব যে আলো আসে তা নয় কিন্তু সারাদিনে শুখিয়ে যায়।
যেহেতু বারান্দা একটাই তাই সেই সামান্য আলোটুকুও
আমাদের কাছে দুর্লভ ছিল শরীরে মাখা।
রুমের জানালার একদম সোজায় আরেকটা
জানালা তাই পর্দা খুলে বাইরে তাকানোর কোন সুজুগ ছিল না।
টোনাটুনির সংসারের জন্য সমস্যা হয় নি।
সাদিকের জন্মের পরও কিছুই মনে হয়নি কিন্তু
সময়ের সাথে সাথে ওর বেড়ে ওঠা আর পরিবেশ আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে।
প্রথম পরিবেশ তৈরির ভাবনা :
যখন সাদিকের বয়স ৫ মাস তখন লক্ষ্য করলাম সে আর এক যায়গায় থাকে না।
পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে অথবা গড়াগড়ি করে। বিছানা থেকে পড়ে যায়।
যেহেতু আমি একা সারাক্ষন বাচ্চার কাছে বসে থাকতে মন চাইলেও উপায় নাই।
কারণ রান্না বান্না ঘর গুছানো।
তাছাড়া দুপুরে সাদিকের বাবা খেতে আসে কারণ ওর অফিস কাছেই ছিল।
তাই সময়মত রান্না করা। যেন পড়ে গিয়ে ব্যথা আর না পায় তাই মেঝেতে কাঁথা ,
ওয়াল ক্লোথ দিয়ে বিছানা করে শুয়ে রাখি।
এই কাজটা করার আগে নিশ্চিত করেছি।
খাটের নিচে ,টেবিলের নিচে ,আনাচে কানাচে কোন ময়লা আছে কিনা।
খাটের নিচে হাবি যাবি ছিল সেইগুলা বের করে ধুলা বালি পরিষ্কার করেছি।
সুবিধা :
বাচ্চা ইচ্ছা মত গড়াগড়ি করেছে। আমি নিশ্চিত ছিলাম পড়ে যাবার ভয় নেই।
মুখে হাত দিয়ে ময়লা তুলে নেবার চিন্তা নেই।
কাজ করে বার বার দেখে যাবার মত মনের ভিতর অস্থিরতা নেই।
দ্বিতীয় পরিবেশ তৈরির ভাবনা :
আট মাস হামাগুড়ি দেয় আলহামদুলিল্লাহ। আর আটকানো যায় না।
ওর কাজ হল বিদ্যুৎ প্লাগে হাত দেওয়া।
সিপিউ চাপ দেওয়া। আমি ঘরে থাকা সব নিচের প্লাগ গুলি,
সিপিউ কস্টেপ দিয়ে বন্ধ করে দিলাম।
কম্পিউটারের তার গুলি একসাথে করে বেঁধে চোঁখের আড়ালে রাখলাম।
এইবার পুরা ঘরে শপ বিছিয়ে দিয়েছি।
এর কারণ হল বাসা টা পুরাতন ছিল। হামাগুড়ি দিলে কোথায় প্লাস্টার খারাপ থাকলে আর হাঁটুতে লাগবে না।
প্লাস্টিকের ঝুড়ি থেকে ওর কাপড় গুলি বের করে মেজেতে ফেলত।
আমি ছোট ছোট প্লাষ্টিকের বক্স কিনলাম সেখানে ওর ক্যাটাগরি অনুযায়ী
কাপড় গুলি আলাদা করে গুছিয়ে ওর চোখের আড়ালে রাখলাম।
সুবিধা :
সাবধানতার শেষ নেই। তবুও কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকা গেল।
ঘর এলোমেলো করার সুজুগ নেই।
বেডরুম গুছানো :
পুরা ঘর গুছাইছি যখন যেভাবে পরিবর্তন করার দরকার ছিল।
ওর বয়সের সাথে সাথে ,
বাচ্চার এক্টিভিটির সাথে আমি আমাকে ,আমার ঘরকে বদলিয়েছি।
হয়ত আপনাদের কাছে অবাক লাগতে পারে।
কয়েকটা উদাহরণ দেই।
যখনি কোলে নিতাম ওর কাজ ছিল কানের দুল ,নাকের ফুল ,গলার চেইন ধরে টান দেওয়া।
আমি সেইগুলি পড়া বাদ দিলাম। কারণ নিজের ব্যথা আর জিনিস নষ্ঠ হওয়া থেকে বেঁচে গেলাম।
আমার ঘরে একটা ডাইনিং টেবিল ছিল। সেখানে উঠে যায় ক্রিম হাবি জাবি ফেলে নষ্ঠ করা তার খেলা।
আমি সাজুগুজু করতাম না তেমন তাই এই কঠিন কাজটা করা আমার জন্য সহজ ছিল।
সব ইউজ করা একদম বাদ দিলাম। শুধুমাত্র নারিকেল তেল ছাড়া। একটা বোতল লুকিয়ে রাখতাম।
নিচ্ তলায় এক ভাবি থাকতেন।
ওনার ছোট একটা মেয়ে আছে। প্রায় বলত। আন্টির মত একটা আয়না নিতে।
আমি সুজুগটা কাজে লাগলাম।
একদিন ভাবীকে বললাম ভাবি আমার একটা উপকার করেন প্লিজ।
আমি এইটা আপনার মেয়েকে দিতে চাই।
নিজে স্বামীর সাথে ডাইনিং টেবিল ধরে নিচে ওকে গিফ্ট করলাম ।
উদ্দেশ্য ঘরে যায়গা তৈরী করা। আমার সময় বাঁচানো।
সুবিধা :
আমার কাছে সন্তানের থেকে দামি কিছুই ঘরে ছিল না।
আবার সারাদিন ঘরের কাজ করে যদি দেখি
মেজেতে এইটা সেইটা পড়ে আছে।
কতবার গুছানো যায় বলেন ?
তার উপর সাদিক বড় হয়েছে ডায়াপার ছাড়া।
দিনে দুই তিনবার বালতি বালতি কাপড় ধোয়া।
ঘর গুছাইতে পেরেছি জন্য একা সব করতে পেরেছি।
কারণ ঘরটা ছিল সাদিকের চাওয়া পাওয়ার উপর।
তৃতীয় পরিবেশ তৈরির ভাবনা :
যখন সে হাঁটতে আর দৌড়াইতে শিখল।
বাচ্চাকে দেখে মনে হয় ঘরটা তার জন্য খুব ছোট।
সারাদিন খেলে দৌড়ায়।
একটা ঘরের মধ্যে। আমার সামান্য খারাপ লাগল।
কারণ ওকে আমি খোলা মাঠ দিতে পারি না ,
আকাশ দেখতে দিতে পারি না।
সে বাইরে যাবার জন্য কাঁদে। বাবা আসে সেই রাট ৯/১০ টায়।
এর মধ্যে সাদিকের চাচা আসে একটা ঘরে ওর থাকার বাবস্থা করি।
ওর লাইফষ্টাইল এমন যে ওই ঘরটা কোন কাজেই ব্যবহার করা যায় না।
মনে হতে থাকে সাবলেটে আছি আমি।
ঘরের খাট তুলে ফেলি।
ফ্লোরিং করি। সামান্য যায়গার জন্য। কম্পিউটার টেবিল টা সরিয়ে দেয়ালে
একটা কাঠের তক্তা দিয়ে মিনিমাল টেবিল বানানো হয় ,
কিছু যায়গার আশায়। জানালার পর্দা নেটের বাবস্থা করি যেন আলো বাতাস আসে।
কেউ যেন আমাকে না দেখে এই জন্য সারাক্ষন মাথায় কাপড় দিয়ে রাখতে হয়।
সুবিধা :
সে খেলতে পারে। বাচ্চারা যদি খেলার পরিবেশ পায় তাহলে মাকে অতিরিক্ত বিরক্ত করে না।
আমিও নিজের সংসারের কাজ গুলো সানন্দে করতে পারতাম। তবে তারা কি পছন্দ
করছে সেই দিকে খেয়াল রেখে পরিবেশ তৈরী করতে হয়।
খেলার পরিবেশ তৈরী :
আমি লক্ষ্য করলাম খেলনা তার খুব একটা পছন্দ নয়। চায় ,দিলে খুশি হয়
কিন্তু এই খুশির স্থায়িত্ব কাল খুবই কম।
সাইকেল খুব পছন্দ করে। আমি রাস্তার পাশ থেকে বালুর ব্যবস্থা করে বারান্দায় রেখে দিলাম।
গোছলের আগে খেলতে দিতাম।
খুব খুশি শুধু তাই নয় আর খেলনায় হাতও দিল না। সাইকেল চালায় আর বালু দিয়ে খেলে।
সুবিধা :
সাদিক আমাকে কাছে পাবার জন্য খুব বিরক্ত করত না। কারণ
আমি তাকে বুজতে চেষ্টা করেছি সেইভাবে
নিজের সামর্থের মধ্যে পরিবেশ তৈরী করার চেষ্টা করেছি।
পরিবেশের জন্য বাসা বদল :
অনেকের চোখ কপালে উঠতে পারে। যে টাকা থাকলে সম্ভব। তা মোটেও সত্য নয়।
আমাদের কোন ডিপোজিট নেই।
মাস শেষে বেতনের টাকা দিয়ে দু বেলা খাবার আর
ঘর ভাড়া এইতো জীবন আলহামদুলিল্লাহ।
সাদিকের বয়স দুই বছর এতদিনে সাইকেল চালানো খুব ভাল ভাবেই শিখে গেছে।
আবেগ থাকলে যা হয়। সেই অল্প জায়গার মধ্যে চিপা চাপা দিয়ে
রান্না ঘরে গিয়ে বলত মামনি যায়গা নাই।
ওর কথা আমার খুব কষ্ট লাগত।
এখন আর খেলনা দিয়ে খেলে না সারাদিন সাইকেল আর মোড়া
নিয়ে এসে বারান্দায় উঠে গ্রিল ধরে রাস্তায় হেঁটে যাওয়া মানুষ ডাকত।
দুইটাই তার জন্য কষ্টের।
কারণ ছোট বারান্দা তার উপর অর্ধেক দেয়াল।
কাপড় ঐখান টাতেই দেই।
তাই মামুনি যায়গা নেই ,বাক্যটা আমাকে ভাবিয়ে তোলে বাসা বদলের কথা চিন্তা করতে শেখায় ।
আমি জানতাম ওর বাবা রাজি হবে না সহজে।
কারণ অফিস কাছেই। দুই এই এলাকায় সবচেয়ে কম দামের ফ্ল্যাট মনে হয় আমাদেরটাই ছিল।
আমি অনলাইনে খোঁজ করলাম দেখলাম আমরা যে ভাড়া দিয়ে থাকি সেই টাকায় বড় সুন্দর ফ্ল্যাটেই পাব কিন্তু
তাকে নিয়মিত বাসে আশা যাওয়া করতে হবে।
অনেক দূরে বাসা নিতে হবে। ওর সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলাম।
মধ্যবিত্ত পরিবারের বাস্তব চিত্র আরকি।
স্বপ্ন অনেক বড় থাকলেও সামর্থ্য অনেক ছোট।
যাক বাসা বদলের গল্প আরেকদিন লিখব।
শুধু এতটুকু বলি।
স্বামীর কাছে এই অনুমতি পেতে আমাকে ১২ মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে।
তারপর আমরা এখন নতুন বড় বাসায়।
আমার এই বাসার পরিবর্তন করার মানুসিকতা
সংসারের স্বাভাবিক কাজকে অনেক সহজ করেছে।
বাচ্চাও যা চেয়েছে তাই তৈরী করার চেষ্টা করেছি।
কোনটাই তার অতিরঞ্জিত চাওয়া ছিল না।
এগুলো বয়সের একটা চাওয়া।
ঠিক এই কারণে হয়ত সে জেদি ,রাগি কিংবা অতিরিক্ত চঞ্চল নয়।
কারণ ওরা মানুষ ওদের চাওয়া পাওয়া থাকে ,আমরা যদি
এই সব উপলব্ধি করতে পারি তাহলে তাদের রাগ কন্ট্রোলে রাখা যায়।
এই বয়স গুলিতে ওদের আবেগ ওরা বুজিয়ে বলতে পারে না।
বাবা মাকে বুজে নিতে হয়। আর বুজতে হলে ওদের দিকে খেয়াল রাখা ,
বাচ্চার প্রতি ইতিবাচক মনোযোগ খুব জরুরী।
শুধু জানি এবং বিশ্বাস করি সন্তানের থেকে দামি সংসারের জন্য কিছুই হতে পারে না।
সন্তান মানুষ হলে বাবা মায়ের জন্য সোনার একটা খনি ইহকাল এবং পরকালের জন্য।
আমরা চেষ্টা করছি মাত্র। কবুল করার মালিক উপর ওয়ালা।
[…] একটা পরিবেশ তৈরী করে দেবার গুরুত্ব। অনেকেই ভাবতে […]
[…] […]